মোবারকগঞ্জ চিনিকলের উৎপাদন কমছে

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ সুগার মিল ২০২৩-২৪ মাড়াই উদ্বোধনের পর প্রায় অর্ধেক সময়ই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ ছিল। ফলে চলতি মাড়াই মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত চিনি উৎপাদন ব্যাহতের আশঙ্কা মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের।

গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেলে মিলের ডোঙ্গায় আখ ফেলে মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করেন বিএসএফআইসি’র প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম। মাত্র একদিন পরই শনিবার দিবাগত রাত ১২টায় বয়লারে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর রোববার বিকেল ৫টায় আবার মাড়াই শুরু করার ১৩ ঘণ্টা পর আবারও যান্ত্রিক ত্রুটিতে মাড়াই বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এদিন মিলের যন্ত্র বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের চেষ্টায় আট ঘণ্টা পর শুরু করে। ফলে মাড়াই শুরুর মাত্র চার দিনে ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে মিলটি। এভাবে চলতি মৌসুমের ২৩ দিনে প্রায় অর্ধেকটা সময়ই বন্ধ ছিল মিলটির মাড়াই। যদিও মিলের রেকর্ড বলছে ২৩ কার্যদিবসে বন্ধ ছিল ১০৪ ঘণ্টা।

এদিকে মিলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিল শুরুর আগেই ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা বাজেট ধরে যন্ত্রপাতি পুনঃমেরামতের কাজ করা হয়। কিন্তু মোটা অংকের এ পরিমাণ টাকার পুনঃমেরামত কোনো কাজে আসেনি।

চলতি মাড়াই মৌসুমে ৪০ দিনে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে তিন হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে মাড়াই শুরু করে। চিনি আহরণের গড় ধরা হয় ৬ শতাংশ। কিন্তু ১৩ জানুয়ারি এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিলের চিনি আহরণের গড় ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এদিন পর্যন্ত ২৩ কার্যদিবসে মিলটি চিনি উৎপাদন করে ১৪ হাজার ৪০৪ বস্তা। যার প্রতি বস্তার ওজন ৫০ কেজি। একই পরিমাণ রিকোভারিতে গত বছর ওই সময়ে ২৫ থেকে ২৭ হাজার বস্তা চিনি উৎপাদন করেছিল মিলটি। কিন্তু চলতি মৌসুমে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চিনি উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে।

যদিও মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন, চিনি উৎপাদন নির্ভর করে মাড়াইয়ের ওপর। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাড়াই কম হয়েছে, ফলে চিনিও কম হবে এটা স্বাভাবিক।

ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, মিলের যন্ত্রপাতি পুরাতন হওয়ায় এমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

এদিকে মিলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছর মাড়াই শুরুর আগে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা বাজেট ধরে পুরাতন যন্ত্রাংশ পরিবর্তন ও মেরামতের কাজ করা হয়। তবে এ পরিমাণ বাজেট ব্যয় করা হলেও তা কাজে আসেনি বলে জানান শ্রমিকরা। অন্যদিকে এ টাকা খরচ করা হলেও সবকিছু করা হয়েছে গোপনে।

শ্রমিকরা বলছেন, আগে এসব কাজের জন্য ওপেন টেন্ডার করা হলেও এখন তা হয় না। তাদের অভিযোগ, মিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বড় অংকের এ পরিমাণ টাকা শ্রমিক নেতা ও কর্মকর্তারা নামসর্বশ্ব ব্যয় করে বাকিটা আত্মসাৎ করেছেন।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি জানিয়ে বলেন, মিলের মাড়াই শুরুর আগেই সকল ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়। চলতি মৌসুমে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার বাজেট ধরে পুনঃমেরামতের কাজ করা হয়। মিলের টারবাইনে এ বছর ৩০ লাখ টাকা বাজেট ধরে মেরামত করা হয়। তারপরও ত্রুটিটা এবার একটু বেশি হচ্ছে। যে কারণে মাড়াই কম হয়েছে, ফলে চিনি উৎপাদনও কম হয়েছে।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টেন্ডারের বিষয়ে তিনি বলেন, সব টেন্ডার ওপেন নয়। তবে অফিসিয়াল যে নিয়ম আছে তা মেনেই সকল কাজ সম্পন্ন করা হয়। তবে মিলের মাড়াই স্বাভাবিক করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।

গত ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুমে মিলটি আখের অভাবে মাত্র ২৮ দিনে মাড়াই শেষ করে। ওই মৌসুমে কৃষকরা মাঠে আখ রোপণ না করায় রেকর্ডে সবচেয়ে কম সময় উৎপাদনে ছিল মিলটি। এ সময়ে মিলটি ৩৫ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে এক হাজার ৭৪৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে। ওই বছর আখের মণ ছিল ১৮০ টাকা।

যদিও মিলের রেকর্ড বলছে এর আগে প্রতি মৌসুমে মিল এলাকার কৃষকরা ৮ থেকে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আখ চাষ করতেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশ এবং অল্প সময়ে ফুল ফলসহ বিভিন্ন লাভজনক ফসল চাষ হওয়ায় কমে যাচ্ছে আখ চাষ। তবে চলতি মৌসুমে আখের দাম বৃদ্ধি করায় কৃষকরা আবার আখ চাষে ফিরছেন বলে জানান কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর জমিতে পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার। এছাড়া ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র।

প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলক ভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-১৯৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়াও যশোরের দু’টি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে সাড়ে তিন লাখ একর। আখ ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪৮টি।